নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র, রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে বুধবার দিবাগত রাতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিটের ৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চেষ্টার পর বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এর আগেই ভবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং একজন ফায়ার ফাইটার মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি সচিবালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং জরুরি অবস্থার মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ও বিস্তার
ফায়ার সার্ভিস কন্ট্রোল রুম থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়। ১টা ৫৪ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আগুনের তীব্রতা দ্রুত বাড়তে থাকায় পর্যায়ক্রমে ১৮টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আগুনের লেলিহান শিখা বহুদূর থেকেও দেখা যাচ্ছিল এবং ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো এলাকা।
ক্ষয়ক্ষতির চিত্র
ভবনের ৬, ৭, ৮ ও ৯ তলা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ মাইন উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে জানান, আট ও নয় তলার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, বিশেষ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংবেদনশীল ফাইল এবং প্রশাসনিক দলিলপত্র পুড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ভবনে যেসব মন্ত্রণালয়ের দপ্তর ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়
- ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়
- স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়
- শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
- অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিছু অংশ (সম্পূর্ণ অর্থ মন্ত্রণালয় এই ভবনে ছিল না)
- সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কিছু অংশ
ভবনের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক। ছাদ এবং দেয়ালের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানা গেছে।
উদ্ধার কার্যক্রম ও নিরাপত্তা
ফায়ার সার্ভিসের ১৮ টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। স্থান সংকটের কারণে ১০টি ইউনিট সরাসরি কাজ করতে পারলেও, বাকি ইউনিটগুলো আশেপাশের এলাকা থেকে পানি সরবরাহ এবং অন্যান্য সহায়তায় নিয়োজিত ছিল। আগুন নেভানোর সুবিধার্থে ভবনের গেট ভেঙে দুটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করানো হয়। অগ্নিকাণ্ডের পর সচিবালয় ও এর আশেপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও এপিবিএন সদস্যরা মোতায়েন রয়েছেন এবং পল্টন থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত প্রধান সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
ফায়ার ফাইটারের মর্মান্তিক মৃত্যু
অগ্নি নির্বাপণের সময় একটি দ্রুতগামী ট্রাক (কাভার্ড ভ্যান) ফায়ার ফাইটার মো. সোহানুর জামান নয়নকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত ফায়ার ফাইটার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্য ছিলেন এবং দুই বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন। স্থানীয় জনতা এবং শিক্ষার্থীরা ধাওয়া করে কাভার্ড ভ্যানটিকে আটক করে এবং চালককে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। এই ঘটনায় আরও একজন ফায়ারকর্মী আহত হয়েছেন, তবে তার আঘাত গুরুতর নয়।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও পরবর্তী পদক্ষেপ
ফায়ার সার্ভিস ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ মাইন উদ্দিন জানান, আগুনের উৎস এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আগুনের প্রকৃত কারণ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।
প্রশাসনের তৎপরতা
আগুন লাগার পর সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং উদ্ধার কাজে সহায়তা করতে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।