এরশাদুল বারী, কোপেনহেগেন থেকে :
বিশ্বের বৃহত্তম ও আর্কটিক অঞ্চলে অবস্থিত ডেনমার্কের স্বায়ত্বশাসিত দ্বীপ গ্রীনল্যান্ডবাসীর ভবিষ্যৎ এখন কোন পথে এগুচ্ছে তা নিয়ে রীতিমতো ঘুম হারাম বিশে^র অন্যতম শান্তিপ্রিয় হিসেবে পরিচিত ড্যানিশ জনগোষ্ঠীর।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক দ্বীপটি দখলের হুশিয়ারি এবং দ্বীপটিতে তার ছেলের আকস্মিক সফরের পর ডেনমার্ক ও গ্রীণল্যান্ডের সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় একই সুরে গ্রীণল্যান্ডবাসীর দীর্ঘদিনের চাওয়া স্বাধীনতার বিষয়টি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। উভয় সরকারই বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে যাওয়ার চেয়ে আমরা গ্রীণল্যান্ডবাসীর স্বাধীনতাকেই অগ্রাধিকার দিতে চাই। এ নিয়ে বর্তমানে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে অঞ্চলটিতে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গ্রীণল্যান্ড ইস্যুতে করণীয় র্নিধারণে সম্প্রতি ডেনমার্কের সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে এক জরুরী বৈঠক করেছেন ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন। একই ইস্যুতে কমনওয়েলথ নেতাদের সাথেও পৃথক বৈঠক করেন তিনি। তাছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে এ ইস্যুতে কথা বলতে সাক্ষাৎ করার আগ্রহও প্রকাশ করেছেন ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়া গ্রীনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউটে বুরুফ এগেদে ডেনমার্কের রাজার সাথে সাক্ষাতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এ্যালান লেভেনথালের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা গুঞ্জনও চলছে। প্রশ্ন উঠছে আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে আয়তনে ডেনমার্কের তুলনায় কয়েকগুন বড় এই দ্বীপটির ভবিষ্যৎ নিয়ে?
উত্তেজনার শুরু যেভাবে :
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই একাধিকবার ডোনাল্ড ট্রাম্প আর্কটিক অঞ্চলের বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রীনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে তার প্রবল আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। শুধু এখনই নয়, এরআগে ২০১৯ সালে তার প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থাতেও তিনি এমন আগ্রহ দেখান। তবে গত মঙ্গলবার আরও একধাপ এগিয়ে হোয়াইট হাউজে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে অর্থনৈতিক বা সামরিক বলপ্রয়োগের সম্ভাবনাকে তিনি উড়িয়ে দিতে চান না। ঠিক একই দিনে ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত এই দ্বীপটিতে বাবার ব্যক্তিগত বিমানে করে ৬ ঘন্টার এক সংক্ষিপ্ত সফরে যান ট্রাম্পের বড় ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র।
ট্রাম্পের এমন উচ্চাকাঙ্খা প্রকাশের পরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রীনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউটে বুরুফ এগেদে বলেন, গ্রীনল্যান্ড আমাদের। আমরা বিক্রির জন্য নই এবং কখনও এমনটা ঘটবে না। দীর্ঘদিন ধরে আমরা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছি এবং নিশ্চিতভাবেই তা আমরা বৃথা যেতে দেব না।
ড্যানিশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লার্স লোককে রাসমুসেন বলেছেন, আমরা পুরোপুরি স্বীকার করি যে, গ্রীনল্যান্ডের নিজেরও উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। যদি সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে গ্রীনল্যান্ড স্বাধীন হবে। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল রাজ্য হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই।
কেন হঠাৎ করে গ্রীনল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে এতো হৈচৈ কান্ড :
৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্য ও খনিজ সম্পদের ভান্ডার খ্যাত বিশ্বের বৃহত্তম এই দ্বীপ গ্রীনল্যান্ডের আয়তন ২১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬ বর্গকিলোমিটার। অথচ বিশাল আয়তনের এই দ্বীপটির জনসংখ্যা মাত্র ৫৬ হাজার ৫৮৩ জন। যেখানে ডেনমার্কের আয়তন মাত্র ৪৩ হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৫৯ লাখ ৮২ হাজার ১১৭ জন। গ্রীনল্যান্ডের এই জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশই ইনুইট জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। গ্রিনল্যান্ডের অবস্থান উত্তর আমেরিকা অঞ্চলে হলেও দ্বীপটি ডেনমার্কের অধীন একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রদেশ। এ দ্বীপের বাসিন্দারাও ডেনমার্ক এবং ইউরোপের দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নাগরিক। এছাড়া গ্রীনল্যান্ডের পাশাপাশি ডেনমার্কের অধীন আরেকটি দ্বীপ রয়েছে ফ্যারো আইল্যান্ড।
মুলত আর্কটিক ও আটলান্টিক সাগরকে পৃথককারী দ্বীপটির নাম গ্রীনল্যান্ড হলেও উত্তর মেরুর কাছাকাছি অবস্থান হওয়ার কারণে বছরের বড় একটি সময় তুষারাচ্ছাদিত থাকে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, দ্বীপটির ভূপৃষ্ঠের গভীরে জ্বালানি তেলসহ অব্যবহৃত বিভিন্ন খনিজ সম্পদের রয়েছে বিশাল ভান্ডার যা বৈশ্যিক চাহিদার অন্যতম কারণ হতে পারে।
১৯৫১ সালের এক চুক্তিতে গ্রীনল্যান্ড দ্বীপে ডেনমার্কের মৌলিক সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা হলেও বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া-পাওয়াই প্রধান্য পেয়েছিল। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আমেরিকানরা কখনও দ্বীপটি ছেড়ে চলে যাননি এবং এটিকে তাদের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। দ্বীপটিতে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি ও প্রচুর সৈন্য রয়েছে। যে কারণে এই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তেমন কোন কঠিন চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে না।
অন্যদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এই অঞ্চলে রুশ ও চীনের তৎপরতা বৃদ্ধির পর আর্কটিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণেও এই দ্বীপটি নিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এও বলছেন যে, সারা বিশ্বের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, গ্রীনল্যান্ডের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ এই মুহূর্তে অত্যাবশ্যক।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পদক্ষেপের হুমকি ডেনমার্কের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় বিপদ। কারণ ড্যানিশ ও ইইউ পণ্যের ওপর ব্যাপক পরিমাণে শুল্ক বৃদ্ধি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে মার্কিন প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের কারণে গ্রীনল্যান্ডের ওপর কিছু ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছে ডেনমার্ক।
ডেনমার্কের পাশে ইইউসহ বিশ্বনেতারা :
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষার চরম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, গ্রীনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয় এবং এর আঞ্চলিক অখন্ডতা অবশ্যই রক্ষা করা হবে। একই ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সতর্ক করেছে জার্মানি ও ফ্রান্স।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বলেছেন, সীমানার অখন্ডতার নীতি প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তা খুব ছোট বা খুব শক্তিশালী দেশ যাই হোক না কেন।
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাঁ-নোয়লে ব্যারো বলেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কখনোই বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সার্বভৌম সীমান্তে আক্রমণ করতে দেবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করবে, এমন বিশ্বাস তিনি করেন না বলেও জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:
ড্যানিশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক উলরিক গ্যাড বিবিসিকে বলেছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাইওয়ান নিয়ে যেভাবে কথা বলেন কিংবা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যেভাবে ইউক্রেন নিয়ে কথা বলেন, ট্রাম্প মনে হয় সেভাবেই কথা বলছেন।
রয়্যাল ড্যানিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক জ্যাকবসেন বলেন, গ্রীনল্যান্ড দ্বীপে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তবে ওয়াশিংটনের যেকোনও ধরনের সামরিক শক্তির ব্যবহার একটি আন্তর্জাতিক ঘটনার সৃষ্টি করতে পারে।
ডেনমার্কের স্থানীয় দৈনিক পলিটিকেনের প্রধান রাজনৈতিক সংবাদদাতা এলিজাবেথ স্যাভেন বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র গ্রীনল্যান্ড আক্রমণ করে, তাহলে সেটি ন্যাটোকে আক্রমণের শামিল হবে। যে কারণে এটি সেখানেই থেমে যাবে। তখন আর্টিকেল-৫ কার্যকর করতে হবে। আর যদি কোনও ন্যাটো দেশ ন্যাটোকে আক্রমণ করে, তাহলে সেখানে এই জোট থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, দপ্তরে প্রবেশের আগে ট্রাম্পের নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার মতো একটি ঘটনা এটি। আর স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে আরও আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব অর্জনে এই উপলক্ষটি ব্যবহার করছে গ্রীনল্যান্ড।